জুলাই বিপ্লব: প্রত্যাশা, প্রতারণা, পুনর্জন্ম?

                                          জুলাই বিপ্লবের ছায়ায় ইতিহাস জাগে                                        

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক মুহূর্ত আছে, যেগুলো চিরদিন মনে রাখার মতো। তবে ২০২৫ সালের জুলাই মাসের ঘটনাগুলো যে এত গভীর প্রভাব ফেলবে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। এই সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ, আন্দোলন, রক্তপাত এবং মতাদর্শের দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে একটি নতুন অধ্যায়, যেটিকে অনেকেই বলছেন "জুলাই বিপ্লব"।



এই লেখায় আমরা দেখার চেষ্টা করব—এই বিপ্লব কি সত্যিই দেশের জন্য আশার নতুন আলো, নাকি এটি ছিল কেবল আরেকটি রাজনৈতিক প্রহসনের নাম?


বিপ্লবের আগুন কোথা থেকে শুরু?

বিপ্লব শব্দটি শুনলেই মনে পড়ে যায় ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব কিংবা আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই শব্দটির মধ্যে আছে বিশাল এক আবেগ, পরিবর্তনের আহ্বান। ২০২৫ সালের জুলাই মাসেও তেমনই এক পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নামে হাজারো তরুণ। তারা বলছিল, "এই রাষ্ট্র আমাদের নয়, আমরা আমাদের রাষ্ট্র গড়ব"।

এই দাবি শুনতে যতটা চমৎকার, বাস্তবতায় তা ছিল ততটাই জটিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল কিছু নতুন রাজনৈতিক সংগঠন, বিশেষ করে তখনকার নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP)। তারা বলছিল, এই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পুরনো হয়ে গেছে—এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।


ছাত্রনেতৃত্ব নাকি রাজনৈতিক উচ্চাশা?

যে বিষয়টি অনেকের নজর কাড়ে, তা হলো—এই বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কলেজপড়ুয়া তরুণ, এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। তাদের স্লোগান ছিল নতুন সংবিধান, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়—এই নেতৃত্ব কি সত্যিই ছাত্রদের হাতে ছিল, নাকি পর্দার আড়ালে ছিল পুরোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর খেলা? অনেক বিশ্লেষক বলেন, এসব ছাত্রনেতা হয়তো নিজেরাও বুঝতে পারেননি, তারা কার হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে।


গোপালগঞ্জের রক্তাক্ত দুপুর: এক মোড়বদলের দিন

১৭ জুলাই ২০২৫—এই তারিখটি অনেকের মনে গেঁথে থাকবে। এই দিনে গোপালগঞ্জে ঘটে যায় এক ভয়াবহ সংঘর্ষ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে যখন পদযাত্রা চলছিল, তখনই রাজনৈতিকভাবে উত্তেজিত একদল সরকারপন্থী লোক ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। গুলি, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ—সব কিছু মিলিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে লাশ, রক্ত, কান্না আর আতঙ্ক।

এই ঘটনার পর সরকার বলেছে, এটি ছিল রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র। আর আন্দোলনকারীরা বলেছে, এটি ছিল গণআন্দোলন দমন করার একটা অপচেষ্টা। এই দুই বিপরীত ব্যাখ্যার মাঝে সত্যটা কোথায় ছিল, তা আজও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।


NCP-এর উত্থান ও নেতৃত্বের রহস্য

NCP-এর মুখ্য নেতা নাহিদ ইসলাম নামক এক তরুণ, যিনি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি হঠাৎ করেই হয়ে ওঠেন গণআন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। কেউ বলেন, তিনি সাহসী, স্বপ্নবান। আবার অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন মাত্র একটি মুখ, যাকে ব্যবহার করা হয়েছে এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।

তাঁর বক্তৃতা, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি, দল গঠনের প্রক্রিয়া—সব কিছুই অনেকের কাছে ছিল প্রেরণাদায়ক, আবার অনেকের কাছে ছিল অস্পষ্ট ও অতিরঞ্জিত।


ভাঙন, বিশ্বাসঘাতকতা ও নতুন দল: UP Bangladesh

জুলাই বিপ্লবের অল্প কিছুদিন পরেই দেখা যায়, NCP-এর ভেতর থেকেই তৈরি হয় ভাঙন। দলের কিছু নেতাকর্মী বেরিয়ে এসে গঠন করে নতুন সংগঠন "UP Bangladesh"। তারা বলেছে, NCP আদর্শচ্যুত, নেতৃত্ব অগণতান্ত্রিক এবং ভেতরে ভেতরে লেনদেন চলছে।

এতে করে জনগণের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেকেই ভাবতে শুরু করেন—জুলাই বিপ্লব কি তাহলে কেবল একটি সাজানো নাটক ছিল, যেটির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া?


রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী এবং জনগণের অবস্থান

জুলাই মাসে সংঘটিত এই আন্দোলন কেবল একটি ছাত্র-আন্দোলন ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং কয়েকটি শহরে জারি হয় আংশিক কারফিউ।

সরকারি ভাষ্য ছিল, “এই আন্দোলন রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত।” অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বলছিল, “আমরা রাষ্ট্রকে ভালোবেসে বদলাতে চেয়েছি।” জনগণের একটি বড় অংশ তখন দ্বিধায় পড়ে যায়—কার কথা বিশ্বাস করবে?


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বৈদেশিক চাপ

এই আন্দোলনের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কিছু বিদেশী দূতাবাস এই ঘটনাকে “গভীর উদ্বেগজনক” বলে আখ্যা দেয়।

কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এই বিদেশী চাপ ছিল একপাক্ষিক এবং অনেক সময় তা রাজনীতিকেই জটিল করে তোলে। অনেকে দাবি করেন, আন্দোলনের পেছনে কিছু বিদেশী চক্রও ছিল, যাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা।


বিপ্লবের মধ্যকার সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা

এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন দেয়ালচিত্র, পোস্টার, স্লোগান এবং কবিতার মাধ্যমে আন্দোলনের ভাব প্রচার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গণসঙ্গীত লিখে-গেয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। একজন তরুণ ছাত্রী তার পোস্টারে লিখেছিল—"সংবিধান আমদের মা, কিন্তু তার গলা টিপে ধরা হয়েছে"।

এইসব সৃজনশীল প্রকাশও ছিল বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকেই বলেন, এই দিকটি প্রমাণ করে, আন্দোলন ছিল সত্যিকারের গণভিত্তিক এবং আবেগনির্ভর।


জুলাইয়ের পরবর্তী সময়: আশাভঙ্গ, গ্রেপ্তার আর নীরবতা

বিপ্লবের পরবর্তী কয়েক মাস ছিল হতাশা, গ্রেপ্তার আর সন্দেহে পূর্ণ। অনেক ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন, অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান চালিয়ে NCP ও UP Bangladesh-এর শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আন্দোলন থেমে যায়, রাস্তাগুলো ফিরে পায় আগের চেহারা। কিন্তু মানুষের মনে থেকে যায় প্রশ্ন—এই যে আত্মত্যাগ, এই যে প্রাণদান—সব কি তবে ব্যর্থ?


নতুন রাজনীতির সূচনা নাকি পুরোনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি?

জুলাই বিপ্লব একটি বিশেষ ঘটনা, যার ব্যাখ্যা এক কথায় দেওয়া যায় না। কেউ বলেন, এটি ছিল রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর চেষ্টার নাম। আবার অনেকে বলেন, এটি ছিল ‘ইনসাইড জব’—অর্থাৎ ভিতরের কারসাজি।

তবে এটা সত্য, এই বিপ্লব কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে যেগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। যেমন:

  • এই রাষ্ট্র কাদের জন্য?

  • আমরা কি এখনো স্বাধীন নাগরিক?

  • নেতৃত্ব কি সত্যিই জনগণের প্রতিনিধি?


শেষ কথা: প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা

জুলাই বিপ্লব হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এর অভিঘাত আজও চলমান। যারা স্বপ্ন দেখেছিল পরিবর্তনের, তারা হয়তো এখন হতাশ। আবার যারা ভেবেছিল সব কিছুই কল্পনা, তারাও দেখেছে—এই দেশের তরুণরা চুপ করে বসে থাকে না।

এই বিপ্লব হয়তো সফল হয়নি রাজনৈতিক অর্থে, কিন্তু এটি মানুষের চিন্তায় এক ধাক্কা দিয়েছে। জনগণ বুঝে গেছে, সময় এসেছে প্রশ্ন করার, দাবি জানানোর, এবং প্রতারণার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার।

শুধু সময়ই বলে দেবে—এই বিপ্লব ভবিষ্যতের জন্ম দিয়েছে, নাকি কেবল অতীতের পুনরাবৃত্তি ছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

=iramedge নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url